সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাজলো তোমার আলোর বেণু,

বাজলো তোমার আলোর বেণু,

বাজলো তোমার আলোর বেণু,


বাজলো তোমার আলোর বেণু,
মাতলো রে ভুবন।
বাজলো তোমার আলোর বেণু।…. 


রেডিওটা বন্ধ করে ঘরের এক কোণে জানলার ধারে বসে পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম, আজ মহালয়া, আজ নিয়ে পাঁচ বছর আমি আমার বেনু হারা।
ঠিক আজকের দিনটায়………….
পাঁচবছর আগে আমার দেবী দুর্গা, আমার বেনু ছেড়ে চলে গেছে। জলের ফোঁটা ভারী হয়ে চোখ দিয়ে ঝরে পড়ার উপক্রম করলো, তার আগেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম, আর যেনো ফিরে গেলাম সেই দিনটায়…..
তখন উঠতি বয়স, শরতের কাশফুলের মতো প্রেম মনের ভূমিতে ফুটেছিল ঠিকই কিন্তু সেটা কোনো ছেলের জন্য নয় মেয়ের জন্য, প্রথমে মনের মধ্যে ভয়, তারপর google বাবার আশীর্বাদে সব কিছুই যেনো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ, তখন প্রেম প্রেম ভাবটা আরো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো, আমাদের মন সত্যিই কারোর কথা শুনে না এমনকি নিজেও না, এমন একজন মন দিয়ে বসলাম তাকে কোনোদিনই নিজের করতে পারবো ভাবিনি, মন দিয়েছিলাম আমার থেকে এক বছর সিনিয়র দিদির ওপর। দেখতে ঠিক দেবী দুর্গার মতো, চোখ দুটো ঠিক টানা টানা, ঠোঁটের কোণে ঠিক মিষ্টি হাসি লেগেই থাকতো, ঠোঁট দুটো থেকে একরকম রক্তিম অভা সব সময় ঝরে ঠিকরে পড়তো। আমি ছিলাম শ্যাম বর্ণের, তাও মনে জোর এনে আমার দুর্গার সাথে পড়ার চলছুত করে বন্ধুত্ব করি। ওকে বেনুর থেকে বেশি দুর্গা বলেই ডাকতাম। ও শুধু একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলতো, “এই তুমি দিন দিন ভারী দুষ্টু হচ্ছো”। 
তারপর এরকমই এক মহালয়ার দিন কথার ছলে বলেই ফেললাম, 
“আমি ছেলে হলে এতদিন কবেই তোমাকে আমার করে নিতাম”
সে কোনো আমার দিকে না তাকিয়ে বলেছিল, “ছেলে নও তো কি হয়েছে, সত্যিই ভালোবাসলে ছেলে বা মেয়ে কোনো ফ্যাক্টর না, তুমি কি সত্যি ভালোবাসবে আমায়?”
কথাটা এখনো কানে বাজে আমার, সেদিন কিছু বলতে পারিনি শুধু আমার দুর্গাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম।
সেই থেকে শুধু পথ চলা আমাদের, প্রথম প্রেম, প্রথম চুমু, প্রথম রাত সব যেনো নকশি কাঁথার মাঠের গল্পের মতো ছিল। কিন্তু সুখ কপালে নেই, আমার দুর্গা আমাকে ছেড়ে সত্যিইকারের দুর্গার কাছে চলে গেলো।
আগের বছর দুর্গা পুজোতে কতো কি ভেবে রেখেছিলাম, ষষ্ঠী তে কিভাবে সাজবো, সপ্তমীতে কোথায় ঘুরবো, অষ্টমী, নবমী কতো কি, সারা রাস্তা হাত ধরে ঘুরবো, ভিড়ে ফষ্টিনষ্টি, আরো কতো কি। কিন্তু সবই থেমে গেলো পঞ্চমীর দিন, পুজোর ছুটির কাজের চাপে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে জানিয়ে আমাকে শুয়ে পড়তে বললো। 
রাত বারোটা পেরিয়ে গেলো এখনো বেনু এলোনা, ফোন সুইচ অফ, না ম্যাসেজের রিপ্লাই আসছে। 
লিভিং রুমে টিভিটা অন ছিলো, টিভির রিপোর্টার বলছে, “আজ একটু আগের খবর অনুযায়ী কলকাতার দ্বিতীয় হুগলি সেতুর উপর একটি সাদা রঙের ola cab গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজ থেকে গঙ্গায় আছড়ে পড়ে। ডুবুরি নামিয়ে সন্ধান চালানো হয় ড্রাইভার ঘটনার স্থলে মৃত্যু হয়। এবং প্যাসেঞ্জার থাকা ব্যক্তি জলে ডুবে যাওয়ায় মৃত্যু হয়, মৃত ব্যক্তির নাম বেনু রায়”
হাত থেকে ফোনটা পড়ে মেঝেতে ছিটকে গেলো। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলো, ঘরের বাতাস যেনো ভারী হয়ে এলো। আমার দুর্গা আর নেই………

তারপর থেকে পাঁচ বছর কেটে, আমার দুর্গা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও আমার দুর্গা প্রতিবছর পাঁচ দিনের জন্য আমার কাছে, প্রতিবছর আমি এই পাঁচ দিন খুব আগ্রহে থাকি। আমার দুর্গা আসার অপেক্ষায়। বেণুর পর আমার আর কাউকে মনে ধরেনি আমি সারাজীবন আমার বেনু আমার দুর্গারই থাকতে চাই।
পুব আকাশ আরো ফর্সা হয়েছে, দূরে কোথাও একটা প্যান্ডেলে গান বাজছে

বাজলো তোমার আলোর বেণু,

মাতলো রে ভুবন।

বাজলো তোমার আলোর বেণু।…. 





মন্তব্যসমূহ