তুঙ্গভদ্রার তীরে
Disclaimer :- This story inspired by novel same name "তুঙ্গভদ্রার তীরে" by Saradindu Bandopadhyay. All characters are fictional if there any similarlities is purely co-incidence
অন্তিম পর্ব
দুজনে বিদ্যুতের গতিতে ছিটকে আলাদা হয়ে গেলো। রাজা দেব রায় তলোয়ার উচিয়ে এগিয়ে এলো, দাঁড়ালো সোমাদৃতার সামনে। সোমাদৃতার চোখ মাটিতে আটকে রইলো।
গম্ভীর গলায় দেব প্রশ্ন করলেন, “যা দেখলাম সেটা কি ঠিক?”
সোমাদৃতা কিছু বলার আগেই বিদ্যুৎমালা দেব রায়ের সামনে এসে করজোড় করে বললো, “মহারাজ, ওনার কোনো ভুল নেই, আমি ওনাকে জোর করেছি আমাকে ভালোবাসার জন্য, উনি আমাকে প্রেম করেন না, সব দোষ আমার, আমায় শাস্তি দিন”।
সোমাদৃতার বুকের এমন কোনো জায়গা রইলো না যে কেঁপে উঠলো না, এতো ভালোবাসে বিদ্যুৎমালা তাকে, তার জন্য বিদ্যুৎমালা সব দোষ নিজের করতে চাই, সোমাদৃতার চোখ বুঁজে এলো কান্নার জন্য কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে শক্ত হতে হবে, তার নিজের জন্য, বিদ্যুৎমালার জন্য, তাদের প্রবিত্র ভালোবাসার জন্য।
সোমাদৃতা এগিয়ে এসে বিদ্যুৎমালাকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, দেব রায়ের চোখে চোখ রেখে গর্জে উঠে, “আপনি যা দেখেছেন সবই ঠিক, আর আমিও বিদ্যুৎমালাকে ভালোবাসি, যতদিন এ শরীর থাকবে ততদিন আমি বিদ্যুৎমালাকে ভালোবেসে যাবো”।
দেব রায় চোখ থেকে যেনো অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে, রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো, “তুমি জানো এতে তোমার চরম পরিণতি হবে”
সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালাকে আরো শক্ত জড়িয়ে ধরে বলে উঠে, “আমি কোনো কিছুকেই ভয় পাইনা মহারাজ, তা আপনি ভালোভাবেই জানেন”
“আচ্ছা, তাই”, দেব রায় তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠে, তারপর দুবার হাততালি দেই, কিছুক্ষনের মধ্যে চারজন সিপাহী এসে রাজা দেব রায়ের পিছনে দাঁড়ায়।
তাদের উদ্দেশে দেব রায় বলেন, “সিপাহী, বিদ্যুৎমালাকে নিয়ে গিয়ে নিজের কক্ষে বন্ধ করে দাও”।
বিদ্যুৎমালাকে দুজন সিপাহী জোর করে ছাড়ানোর এগিয়ে আসলো, আর অন্য দুজন চেপে ধরে রইলো সোমাদৃতাকে। দুজন সবল পুরুষও যেনো হিমশিম খেয়ে এই ক্ষত্রিয় নারীকে ধরে রাখতে। বিদ্যুৎমালাকে টানতে টানতে এগিয়ে নিয়ে চললো দুজুন সিপাহী, কান্না, চিৎকার আর আর্তনাদ যেকোনো পাষাণের হৃদয় বিগলিত করতে সক্ষম, কিন্তু রাজা দেব রায় যেনো কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না, দেখতে পাচ্ছেন কি দুটি আত্মার নিশ্চিদ্র প্রেম? না তিনি পাচ্ছেন না। তিনি এখন তার বাহুবল এবং সন্মান বাঁচানোই ব্যাস্ত। পরিবেশ আবার শান্ত হয়ে গেলো। হয়তো এতক্ষণে বিদ্যুৎমালাকে তার কক্ষে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
দেব রায়ের ইশারাতে সোমাদৃতাকে দুজন সিপাহী ছেড়ে দিল। সোমাদৃতা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। দেব রায় তার সামনে গিয়ে ঝুঁকে বললেন,
“সোমাদৃতা, তুমি আমার একবার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে তাই তোমার দণ্ড মৃত্যু দিলাম না। কাল ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই তুমি বিজয়নগর ত্যাগ করবে, নাহলে মৃত্যু অনিবার্য”।
দেব চলে গেলেন, একরাশ গর্ব বুকে নিয়ে। তার হবু স্ত্রী এর ওপর কেউ নজর দিয়েছে। তাও কোনো পুরুষের নয়, একজন ক্ষত্রিয় নারী। ছি: ভাবলেই রাজা দেব রায়ের গা গুলিয়ে ওঠে।
সোমাদৃতা মাটিকে আঁকড়ে ধরে পড়ে রইলো। চোখের জল এক ফোঁটা দু ফোঁটা পড়ে মাটিকে শিক্ত করে তুললো। সেও ক্ষত্রিয় নারী, এত সহজে ছাড়বার পাত্রী নয়। সে মৃৎ দেবীকে প্রতিজ্ঞা করলেন, তার বিদ্যুৎমালাকে নিজের করে ছাড়বে।
কিছু সময় একই ভাবে পড়ে থাকার পর বলরাম ফিরছিলো কাজ থেকে, সে কিছু দূর থেকে সে তার প্রাণের মিত্রকে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখে দৌড়ে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে সোমাদৃতার মাথা সাথে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষন পর সোমাদৃতা শান্ত হলে পুর্বের ঘটনা সবিস্তারে বর্ননা দিতে থাকে। বলরাম চোয়াল শক্ত করে বলে,
“বন্ধু চিন্তা করো না, রাজকুমারীকে তোমার না করা পর্যন্ত থামছি না”।
এই মুহূর্তে বলরামকে কাছে পেয়ে যেনো সোমাদৃতা নিজেকে অনেকখানি শক্তিশালী মনে করলো। তারা দুজনে একসঙ্গে অনেক্ষণ পরামর্শ করতে থাকলো। আজই মধ্য রাত্রে সোমাদৃতা, বলরাম আর বিদ্যুৎমালাকে নিয়ে বিজয়নগর ত্যাগ করবে। সোমাদৃতা অনেকবার বোঝালো বলরামকে,
“দেখো ভাই তুমি আমার সাথে যেতে চাইছো আমি মানা করবো না, কিন্তু এতে তোমার নিজের বিপদ ডেকে আনবে”।
বলরাম সোমাদৃতার পিঠ চাপড়ে বললো, “এই লজ্জা দিয়ো না, তোমার বিপদ মনেই আমার বিপদ, বন্ধুত্ব করেছি কি বন্ধুকে বিপদের সময় ফেলে পালানোর জন্য?”
সোমাদৃতার চোখ জলে ভরে এলো, সত্যি অনেক ভাগ্য করে এরকম বন্ধু পাওয়া যায়।
মধ্যরাতের কিছু সোমাদৃতা অতিথিশালার প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে পাঁচ মানুষ লম্বা উচু প্রাচীর, অতিথিশালার সবথেকে উঁচু তলায় বিদ্যুৎমালাকে বন্দী করে রেখেছে দেব রায়। এদিকে বলরাম এখন আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে, দুটি ঘোড়া মজুত রাখতে হবে পালানোর জন্য, সে সোমাদৃতার জন্য খয়েরী রঙের তেজী ঘোড়া আর নিজের জন্য সাদা রঙের হালকা ঘোড়া বেছে মুখে লাগাম পরিয়ে দক্ষিণ দিকের দরজার দিকে অতি সন্তর্পনে এগিয়ে যেতে লাগলো, পুর্বের কথা অনুযায়ী সোমাদৃতার, বিদ্যুৎমালাকে নিয়ে এখানে উপস্থিত হবে তারপর তিনজন মিলন হয়ে একসাথে পারি জমাবে।
অন্যদিকে সোমাদৃতা মা ভাবানিকে ডেকে উঠে পড়লো প্রাচীরের গায়ে, আস্তে আস্তে গিরগিটির চিটিয়ে অতি সাবধানতার সহিত প্রাচীর টপকে অতিথিশালার সামনে ঝোপের সাথে মিশে গেলো। অতিথিশালার প্রধান দরজার সামনে দুজন রক্ষী সজাগ হয়ে পাহারা দিচ্ছে। সোমাদৃতা অতিথিশালার পিছন দিকের দেওয়াল বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। বিদ্যুৎমালার ঘরে এখনো আলো জ্বলছে, সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালার ঘরের সামনে উকি মেরে দেখলো, তারও ঘরের দরজার সামনে দুজন রক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। সোমাদৃতা আড়াল থেকে দুটি খুব সূক্ষ্ম ছোরা তার কোমর থেকে বের করলো। ছোরা দুটির ডগায় বিষ মাখানো আছে, যা কোনো ব্যক্তিকে কিছু মুহূর্তের জন্য অজ্ঞান করতে সক্ষম। সোমাদৃতার অব্যর্থ লক্ষ্য ভেদ, দুটি ছোরা উড়ে গিয়ে লাগলো সঠিক নিশানায়, দুজন রক্ষী এলিয়ে পড়লো দরজার সামনে। সোমাদৃতা এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিল, কোনো উত্তর নেই। এক ধাক্কায় দরজা খুলে, ভিতরে প্রবেশ করলো সোমাদৃতা। বিদ্যুৎমালা খাটের পায়ার কাছে বসে খাটে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কান্নায় চোখের কাজল ঘেঁটে গেছে। এতে বিদ্যুৎমালার সৌন্দর্য্য আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালার কাছে গিয়ে ওর সামনে বসে মুখের ওপর ঝুলে থাকা চুল গুলো সরিয়ে কানের পিছনে এটে দেই। করো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে বিদ্যুৎমালা। চেঁচিয়ে উঠতে যাবে তখনই সোমাদৃতা মুখ চেপে ধরে।
“এই, এই, কি করছো দেখো চোখ খুলে, আমি এসেছি”।
বিদ্যুৎমালা বুঝতে পারে এই গলার অধিকারিণী কে, সে মুহূর্তে শান্ত হয়ে যায়। সোমাদৃতাকে জড়িয়ে ধরে তারপর কান্না ভেজা কণ্ঠে বলে,
“আমি জানতাম আপনি আসবেন, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি”।
সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালাকে জড়িয়ে ধরে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে, “কেনো আসবো না, আমি তোমাকে নিতে এসেছি, আমরা আজই এই রাজ্য ছেড়ে পালাবো, আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি”।
এরপর সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালার ঠোঁটে চুম্বন এঁকে দেই। কিছু মুহূর্ত পর সোমাদৃতা আর বিদ্যুৎমালা গুটি গুটি পায়ে ধাপ বেয়ে নামতে থাকে অতিথিশালা থেকে। মুখ্য দরজায় রক্ষী আছে, তাই তারা পাশের অন্য একটি ঘরের জানলা দিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করে। জানলার সামনে গিয়ে প্রথমে সোমাদৃতা জানলা টপকে বাইরে বেরিয়ে আসে, তারপর বিদ্যুৎমালা টপকানোর জন্য জানলায় পা দিয়ে ঝাঁপ দিতে কিন্তু একটু অসাবধানতার জন্য পা মচকে মুখ থুবড়ে পড়ে, জোরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে বিদ্যুৎমালার। সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালার মুখ চেপে ধরে কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মুখ্য দরজার প্রহরীরা শুনতে পেয়ে যায়। তারা শব্দের উৎসর দিকে ছুটে যায়। সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালাকে কোলে তুলে নিয়ে দৌড় দেয়, বিদ্যুৎমালা শক্ত করে সোমাদৃতার গলা জড়িয়ে ধরে। সোমাদৃতার বুকের হৃদযন্ত্র তখন জোরে শব্দ করে চলেছে। বিদ্যুৎমালা এতো কাছ থেকে সেই শব্দ শুনতে পেয়ে নিজেকে সার্থক মনে করলো। ঘোর বিপদেও তার মনে এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। প্রেমিকার বুকের শব্দের থেকে আর কোনো ভালোলাগে কি?
একজন রক্ষী ছুট দিলো সোমাদৃতার পিছনে, আরেক জন দৌড়ে গিয়ে রাজগৃহের ঘণ্টা বাজিয়ে। তারপর রাজা দেব রায়ের কক্ষে গিয়ে সব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আগুনে ঘি দিয়ে বসলো। দেব রায় চোয়াল শক্ত করে তীর ধনুক নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সোমাদৃতা তখন দক্ষিণের দিকে ছুটে যাচ্ছে, কোলে বিদ্যুৎমালা থাকায় গতি ক্রমশ মন্থর হয়ে আসছে, কিন্তু সে ক্ষত্রিয় নারী এতো সহজে হার মানার পাত্রী নয়। শরীরের শেষ টুকু শক্তি লাগিয়ে তার প্রেমকে জীবিত রাখতে চাই। দেব রায় বুঝতে পারেন, সোমাদৃতা দক্ষিণের দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে। দক্ষিণের মুখের দিকে ধনুকে তীর এঁটে লক্ষ্য স্থির করতে থাকেন। যখন সোমাদৃতা প্রায় দক্ষিণের দরজার সামনে, তখন বলরাম দেখতে পায়, দুর থেকে আবছা মূর্তি ধনুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুঝতে বাকি থাকে কি হতে চলেছে, সে হাত নেড়ে সোমাদৃতাকে ইশারা করতে থাকে। কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা সোমাদৃতা ঘোড়া লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে থাকে। যখন ঘোড়ার সামনে হাঁফ ছাড়ে তখন দেব রায়ের ধনুক থেকে বাণ নিক্ষেপ হয়ে গেছে। বলরাম ওদের সামনে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেব রায়ের অব্যর্থ লক্ষ্য বলরামের বক্ষ চিরে আটকে যায়। বলরাম বুক চেপে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গোঁঙাতে গোঁঙাতে একটি শব্দই উচ্চারণ করতে পারে,
“পা..লা……ও….”, ব্যাস তারপরেই সব নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। সেই গুনিনের ভবিষ্যত বাণী সত্য হয়ে উঠে।
দেব রায় লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়েছেন বুঝতে পারেন। তিনি আবার ধনুকে বাণ প্রস্তুত করেন। কিন্তু সোমাদৃতা এবার আর দেরি না করে বন্ধুর দেহ ওখানেই ছেড়ে ঘোড়ায় বিদ্যুৎমালাকে চাপিয়ে তারপর নিজে একলাফে ঘোড়ায় উঠে লাগামে টান দেই। ঘোড়া তীর বেগে দক্ষিণের দরজা দিয়ে বিজয়নগর পরিত্যাগ করে।
পূর্ব আকাশ সবে একটু ফর্সা হয়েছে। সোমাদৃতা একবার আকাশের দিকে তাঁকিয়ে সব থেকে উজ্জ্বল তারাটাকে দেখে পথ ঠিক করে নেই। তুঙ্গভদ্রার তীর বরাবর ঘোড়াকে নামিয়ে দেই। তারপর নীচের টিকে তাকায়, বিদ্যুৎমালা তাকে জড়িয়ে শান্ত ছোটো বালিকার মতো ঘুমাচ্ছে, সোমাদৃতা বিদ্যুৎমালাকে চাদর দিয়ে কোমরের সাথে বেঁধে রেখেছে, পড়ে যাওয়ার ভয়ে। ঝুঁকে বিদ্যুৎমালার কপালে একটা চুম্বন করে সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালা ঘুমের মধ্যেই একটা শব্দ করে আরো শক্ত করে চেপে ধরে সোমাদৃতাকে। সোমাদৃতার একটু আগের সব ঘটনা মনে পড়তে লাগলো। বন্ধু বলরামের কথা মনে পড়তেই বুকটা কেঁপে উঠলো। গলা ব্যাথায় চিনচিন করে উঠলো। দুচোখ ভরে এলো জলে। কয়েক ফোঁটা গাল বেয়ে পড়তে লাগলো, বিদ্যুৎমালার ঘুম ভেংগে যাওয়ার ভয়ে চোখ মুছে ঘোড়ার লাগামে জোরে টান দিল। পাড়ি দিল অন্য এক তুঙ্গভদ্রার তীরে………..!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন