তুঙ্গভদ্রার তীরে
Disclaimer :- This story inspired by novel same name "তুঙ্গভদ্রার তীরে" by Saradindu Bandopadhyay. All characters are fictional if there any similarlities is purely co-incidence
সপ্তম পর্ব
বিদ্যুৎমালা আর সোমাদৃতা ছিটকে দুজনে আলাদা হয়ে যায়, শব্দের উৎস দিকে তাকায়, কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনা। হেমলতা পর্দার আড়ালে নিজেকে অদৃশ্য করে নেই। বিদ্যুৎমালা নিজের কাপড় ঠিক করে নিজের কক্ষের দিকে কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এসে সোমাদৃতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, এবার খুব কাছে পায়ের আওয়াজ পেয়ে দ্রুত বিদ্যুৎমালা নিজের কক্ষের দিকে দৌড় দেই, এতক্ষনে রাজা দেব রায় রাজ গৃহে চলে এসেছেন।
সোমাদৃতাকে সুপ্রভাত জানিয়ে দেব রায় নিজের সিংহাসনে বসার জন্য অগ্রসর হবেন এমন সময় হেমলতা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে বলে,
“মহারাজ আমার আপনার কিছু গোপন কথা আছে”।
দেব রায় কিছুটা অবাক হয় সিংহাসনে বসতে বসতে বলেন, “এত সকালে, কি এমন গোপন কথা?”
এইদিকে সোমাদৃতার বুক দুরুদুরু করে ওঠে কি এই গোপন কথা হতে পারে এটা ভেবে, হেমলতা কি তাহলে সব জেনে ফেলেছে।
হেমলতা একবার সোমাদৃতার দিকে চেয়ে আবার বলে, “মহারাজ খুব কথাটি খুব সংবেদনশীল”
“ওহঃ…” মহারাজ একবার সোমাদৃতার দিকে চকিতে তাকায় তারপর হেমলতার তারপর সোমাদৃতার দিকে তাকাই, সোমাদৃতা বুঝে যাই তাকে মহারাজ দেব রায় কি বলতে চাই, সে কিছু কথা না বলে মাথা নত করে বেরিয়ে যায় রাজ দরবার থেকে।
প্রায় কিছু মুহূর্ত পর আবার দরবার থেকে ডাক আসে, এবারে দরবারের পরিবেশ বেশ গম্ভীর রাজার চোখ রক্ত চন্দনের মতো লাল হয়ে আছে। সোমাদৃতা বুঝে ফেলে রাজা তাদের ব্যাপারে হয়তো জেনে গেছে তবুও মনের সংশয় থাকে।
দেব রায়, সোমাদৃতাকে দেখে বলেন, “আজকে সভার কার্যকলাপ বন্ধ থাকবে, যায় বাইয়ে গিয়ে সবাইকে সূচিত করে দাও, আর তুমিও তোমার কক্ষে বিশ্রাম নাও”।
“যথা আজ্ঞা”, বলে রাজা দেব রায়কে প্রণাম করে কক্ষ থেকে দরজার দিকে অগ্রসর হবার জন্য পা বাড়ায়।
এমন সময় শুনতে রাজা দেব রায়, হেমলতাকে বলছে, “তোমার এই আরোপ যদি মিথ্যা প্রমাণ হয় এর পরিণতি কি হবে তোমার নিশ্চয় জানা, ধড় থেকে শির আলাদা করে দেওয়া হবে তোমার”, দেব রায়ের গলায় একরাশ পুঞ্জীভূত মেঘের মতো গুরুগম্ভীর মনে সোমাদৃতার।
হেমলতার শেষ কথা শোনার জন্য সোমাদৃতা একটু হাঁটার গতি কমালো,
হেমলতা আমতা আমতা করে বলছে, “আমি সত্য বলছি মহারাজ এবং তা প্রমাণ করতে সক্ষম”।
এই কথা শুনে সোমাদৃতার মনে সংশয়ের শেষ বাতিতুকু নিভে গেলো।
এক একটা মুহূর্ত সোমাদৃতার কাছে এক একটা প্রহর মনে হচ্ছে। তাহলে দেব রায় সত্যিই কি জেনে গেছেন, কি করবেন তিনি, নিজের থেকে বেশি চিন্তা তার বিদ্যুৎমালার জন্য হচ্ছে। সোমাদৃতাকে এত আনমনা দেখে বলরাম আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই চঞ্চল হয়ে কি ভাবছো, এক জায়গায় স্থির হয়ে বসো দিয়ে বলো, এত কিসের সংকট এলো তোমার”।
সোমাদৃতা বলরামের মুখোমুখি বসে তারপর এক নাগাড়ে সব ইতি বৃত্তান্ত বলে শেষে কান্নায় ভেংগে পড়ে, আর বলে, “ভাই এখন কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা, আমার বিদ্যুৎমালার জন্য বেশি স্থির থাকতে পারছি না”।
বলরাম, সোমাদৃতার কাঁধে হাত রেখে যথা সম্ভব সহানুভূতি দিলো, আর বললো সব রকমের জন্য সে বন্ধুর সঙ্গ দিতে রাজি, এমনকি রাজার বিরুদ্ধেও।
একটু একটু করে সকালের সূর্য মাঝ আকাশে তারপর পশ্চিমের দিকে ঢলতে লাগলো, একটু সোমাদৃতার আরও চঞ্চল হয়ে আসতে লাগলো, জানে এবার বিদ্যুৎমালার আসার সময় হয়েছে।
সোমাদৃতা একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল, কতক্ষন ছিল তার খেয়াল নেই, ঝুমঝুম নপুরের আওয়াজে বুঝতে পারলো বিদ্যুৎমালার এসেছে, সে একবারটি চোখ খুলে আবার বুজে ফেললো।
বিদ্যুৎমালা ওর পাশে গিয়ে হাঁটুতে মাথা দিয়ে বসলো, সোমাদৃতা আস্তে আস্তে উঠে বসে বিদ্যুৎমালার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো, চুলের মিষ্টি গন্ধ সোমাদৃতার নাকে লাগলো, বেশ আকর্ষণীয়। অনেক্ষণ দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই, তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙে বিদ্যুৎমালা বললো,
“আচ্ছা প্রেমের আক্ষরিক অর্থ কি? জানেন আপনি?”
“না, তবে আমার মতে বোধহয় অপ্রাপ্তি, বা অপূর্ণতা”, আকাশের দিকে চেয়ে বলে সোমাদৃতা।
“কি যে বলেন আপনি, আমি কিছুই বুঝিনা”
“বিদ্যুৎমালা, আমাদের এখানেই থামতে হবে যে”
বিদ্যুৎমালা এবার মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে, সোমাদৃতার চোখে চোখ রাখে, তার অঙ্গনার চোখে উত্তর খুঁজতে থাকে কিন্তু হতাশা ছাড়া কিছুই পাইনা। তারপর কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলে, “কে… কেনো”।
“আমাদের এখানেই সমাপ্তি করতে হবে, নাহলে তোমার বিপদ”
“মহারাজা কি জানতে পেরেছেন? আমাদের ব্যাপারে?”
“আজ নয় কাল তো নিশ্চয় জানতে পারবেন, তখন”
“তখনও আপনাকেই ভালোবাসবো, আপনাকে ভালোবেসেছি কোনো পাপ করিনি”
“তুমি তো এখানের রানী হবার জন্য এসেছিলে, তাহলে তুমি রাজার হবু পত্নী, তুমি কি পাপ করছো না”
“যে রাজার আগে থেকে তিন পত্নী বর্তমান তাকে ভালোবাসতে পারবো না, আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পেয়েছি আর তার সাথে মরতেও রাজি”
সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালার মুখে আঙ্গুল রেখে বলে, “একদম এরকম আর বলবে না, আমার জন্য তুমি কেনো মরবে তুমি, বাস্তব বিচার করে কথা বলো বিদ্যুৎমালা”
“সেই, আমাকেই ধমকান, কেনো রাজার কাছ থেকে আমাকে কেড়ে নিতে পারেন না”
সোমাদৃতা মনে মনে বলে, “তোমার জন্য শুধু রাজা কেনো সারা বিশ্বের বিপক্ষে যেতে রাজি আমি” কিন্তু মুখে বলে, “এতে লাভ কি হবে বলো”
“আমি লাভ ক্ষতি দেখে আপনাকে ভালোবাসিনি, আমার নাম বিদ্যুৎমালা, আপনাকে না পেলে আমি অন্য পথ বেছে নিতে দু বার ভাববো না”
“কি করবে তুমি?”
“প্রাণ আহুতি”
সজোরে গালে চড় মারে সোমাদৃতা, বিদ্যুৎমালা গাল চেপে ধরে, তারপর সোমাদৃতা বিদ্যুৎমালাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে
“এই পাগল, এরকম কথা তোমাকে বারণ করেছি না, আমার কষ্ট হয়না বুঝি, তুমি কি বুঝনা কতো ভালোবাসি তোমায়”
বিদ্যুৎমালা, সোমাদৃতার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “তাহলে এত বিড়ম্বনা কেনো”
“আমার হাত বাঁধা বিদ্যুৎমালা”
দুজন নিরবে কাঁদতেই থাকে, সাক্ষী থাকে অস্তগামী সূর্য, সামনে বয়ে যাওয়া সরোবর, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর, যাদের প্রাণ নেই, কিন্তু আজ এই দুই নারীর সত্য কলঙ্ক হীন ভালবাসার কাছে তারাও কাঁদতে বাধ্য।
“সোমাদৃতা……”, একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার সারা তব্ধ বিকালকে টুকরো টুকরো করে দিলো।
সোমাদৃতা চেয়ে দেখলো সামনে কিছু হাত দূরে মহারাজা দেব রায় হাতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গে প্রধান দাসী হেমলতা।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন